বৌদ্ধ গানের ভাষা
অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ*
আশ্চর্য চর্যাচয় বা চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে যে
চর্যাপদগুলি (যাহাকে সাধারণতঃ বৌদ্ধগান বলা হয়) আছে, তাহার
ভাষা সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বিতর্কগুলি উপস্থিত হয়।—
(১) ইহা
কোনও ভাষা নয়; একটি কৃত্রিম খিচুড়ি ভাষা।
(২) ইহা
অপভ্রংশ।
(৩) ইহা
হিন্দী।
(৪) ইহা
মৈথিলী।
(৫) ইহা ওড়িয়া।
(৬) ইহা
আসামী।
(৭) ইহা
বাঙ্গালা।
আমরা একে একে এই মতগুলির বিচার করিব। (১) “ইহা কোনও ভাষা নয়; একটি কৃত্রিম খিচুড়ি ভাষা।” প্রথমত আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন
যে, যে ৪৭টি বৌদ্ধগান আমরা পাইয়াছি,
তাহা ২২জন কবির রচনা। তাঁহাদের মধ্যে কাহ্ণপাদের রচনা ১২টি; ভুসুকুর ৮টি; সরহের
৪টি; লূয়ী, কুক্কুরী, শান্তি, ও শবর
প্রত্যেকের ২টি; অবশিষ্টগুলির প্রত্যেকের এক একটি। ইহারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আবির্ভূত হন। সুতরাং সকলের ভাষা যে একরূপ
হইতে পারে না, তাহা স্বতঃসিদ্ধ। তবে তাঁহারা যে প্রাচ্য
ভারতে অপভ্রংশের পরবর্তী ভাষাস্তরের সময়ে গানগুলি রচনা করেন তাহা নিশ্চিত। সুতরাং সকলের ভাষা প্রাচ্য ভারতীয় আর্য ভাষা গোষ্ঠীর নব্য ভারতীয় আর্যভাষাভেদ। এই বিষয়ে ইহাদের ভাষার ঐক্য আছে।
এক গোষ্ঠিজাত ভাষা হিসাবে ইহাদের মধ্যে
কতকগুলি সাধারণ লক্ষণ আছে। অন্য
পক্ষে মূলে আদিম প্রাকৃত (Proto-Prakrit)
হইতে উৎপন্ন বলিয়া হিন্দী ইত্যাদি অন্য গেষ্ঠিজাত
নব্য ভারতীয় আর্য ভাষারও সহিত ইহাদের কিছু সাদৃশ্য থাকিতে পারে। অধিকন্তু বৌদ্ধগানের ভাষার
প্রাচীনত্বের দরুন গৌড় অপভ্রংশের কিছু প্রভাব তাহাতে বিদ্যমান আছে এবং প্রত্যেক ভাষার
বিশিষ্ট লক্ষণগুলি তখনও সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় নাই।
বিজয়চন্দ্র মজুমদার বৌদ্ধগানের ভাষাকে কৃত্রিম মিশ্রিত
ভাষা প্রমাণ করিবার জন্য কয়েকটি উদাহরণ দিয়াছেন।
আমি সে-গুলির বিচার করিব।
“কাআ তরুবর পঞ্চবি ভাল,
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।”
তিনি ‘বি’ এবং ‘পইঠো’
শব্দদ্বয়কে হিন্দী বলেন। কিন্তু এই দু’টি আদিম প্রাকৃত (সংস্কৃত) ‘অপি’ এবং
‘প্রবিষ্ট' হইতে ব্যুৎপন্ন।
সুতরাং তাহাদিগকে হিন্দী বলা সঙ্গত নয়। যদিও আধুনিক হিন্দীতে তাহারা রক্ষিত হইয়াছে।
“দুহিল দুধু কি বেণ্টে
ষামায়?”
অর্থাৎ দোওয়া দুধ কি বাঁটে প্রবেশ করে। তিনি দুহিল (দুহিলা
ভ্রান্ত পাঠ) শব্দটিকে ওড়িয়া কিংবা হিন্দী বলেন। কিন্তু ‘ইল’
প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াবাচক বিশেষণ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
প্রভৃতিতে দেখিতে পাওয়া যায়।
ষামায়
(সামায়) শব্দ এখনও বাংলার উপভাষায় পাওয়া যায়।
বৌদ্ধগানের “ভাষা”
বলা ঠিক বৈজ্ঞানিক নাহে। বলা উচিত লূয়ীপাদের ভাষা, কাহ্ণপাদের ভাষা ইত্যাদি। আমরা যতদূর ভাষাতাত্ত্বিক
বিচার করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাতে আর্যদেবের ভাষা ওড়িয়া (চান্দরে
প্রয়োগ দ্রষ্টব্য); শান্তি পাদের ভাষা মৈথিলী; কাহ্ন, সরহ,
ভুসুকু প্রভৃতির ভাষা প্রাচীন বাঙ্গালা
বা বঙ্গ-কামরূপী বলিয়া স্থির করিয়াছি। আমরা বৌদ্ধগানের কোনও কবির ভাষাকে কৃত্রিম বা মিশ্রিত মনে করা ভাষাতত্ত্ব বিরোধী
মনে করি। (দ্রষ্টব্য
মদীয় বাংলা সাহিত্যের কথা)।
(২) “ইহা অপভ্রংশ।” নব্য ভারতীয় আর্যভাষার পূর্ববর্তী
স্তর অপভ্রংশ। অপভ্রংশ স্তরে যুগ্ম-ব্যঞ্জন নব্য ভারতীয় স্তরে একক
ব্যঞ্জনে পরিণত হয় এবং সাধারণতঃ পূর্বস্বরের দীর্ঘত্ব হয়। পাস (লূয়ী),
রাতি (কুক্কুরী), বাকল, (বিরূপ),
দাহিণ
(চাটিল্ল), ছাড়অ (ভুসুকু), বাট (কাহ্ন)
প্রভৃতি প্রয়োগ দ্রষ্টব্য। ইহারা অপভ্রংশে যথাক্রমে পস্স, রত্তি, বক্কল।
দক্খিণ, ছড্ডই, বট্ট। বৌদ্ধগানে এরূপ যুগ্মব্যঞ্জন শব্দের প্রয়োগ নাই। তবে প্রাচীনত্বের কারণে
ভাষায় অপভ্রংশের বিভক্তি সপ্তমীতে হি,
হিঁ প্রভৃতি
রক্ষিত হইয়াছে। সুতরাং ভাষাতত্ত্বের বিচারে আমরা বৌদ্ধগানের ভাষাকে
অপভ্রংশ বলিতে পারি না।
(৩) “ইহা হিন্দী।” হিন্দী (উর্দু), রাজস্থানী প্রভৃতি ভাষাগুলি নব্য ভারতীয় আর্যভাষার মধ্য গোষ্ঠীর (central group) অন্তর্গত। মগধী (বিহারী), ওড়িয়া, বাংলা ও আসামী প্রাচ্য গোষ্ঠীর
অন্তর্গত। প্রাচ্য গোষ্ঠীর বিশিষ্ট লক্ষণ অতীতে ল, ভবিষ্যতে
ব, কর্তায় ও অধিকরণে এ কার বিভক্তি, বর্তমান কালের প্রথম পুরুষের
বহুবচনে অন্তি (মাগধীতে অথি) প্রভৃতি বৌদ্ধগানের ভাষায়
প্রাচ্যগোষ্ঠীর সকল বিশিষ্ট লক্ষণ থাকায়, তাহাকে হিন্দী বলা যায় না। তবে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার সাধারণ লক্ষণ হিন্দী,
বাংলা প্রভৃতিতে দেখা যায়।
এইজন্য “আম খাও” বাক্যটি
হিন্দী ও বাংলায় এক। সুতরাং বৌদ্ধগানের ভাষাকে হিন্দী বলা সঙ্গত হইবে না। বিজয়চন্দ্র মজুমদার মহাশয় পর্যন্ত বলিতে বাধ্য ইহয়াছেন ‘‘I must however, say that in some songs,
Bengali elements predominate’’ (History of the Bengali language, পৃঃ
২৪৩)
(৪) “ইহা মৈথিলী।” আমি বলিয়াছি যে শান্তি পাদের ভাষা মৈথিলী হইতে পারে। অন্য কবিদের ভাষায় মৈথিলীর বিশিষ্ট লক্ষণ, যথা অতীতকালে অল (অন্য সহোদরা
ভাষায় ইল), ভবিষ্যতে অব (অন্য সহোদরা ভাষায় ইব), বর্তমান কালের প্রথম পুরুষের অথি (অন্য সহোদরা ভাষায় অন্তি) প্রভৃতি
দেখা যায় না। সুতরাং এই দুই কবি ব্যতীত অন্য কবিদের ভাষা মৈথিলী
হইতে পারে না।
(৫) “ইহা ওড়িয়া”।
আমি পূর্বে বলিয়াছি যে আর্যদেবের ভাষা
ওড়িয়া হইতে পারে। তদ্ভিন্ন অন্য কোনও কবির ভাষায় ওড়িয়ার বিশিষ্ট, যথা
অধিকরণে রে, আছ ধাতুর অতীত কালে থিল প্রভৃতি দেখা যায় না। সুতরাং তাহাদের ভাষাকে ওড়িয়া বলা যাইতে পারে না।
(৬) “ইহা
আসামী”। ইহাতে কোনও কবির ভাষায় আসামীর বিশিষ্ট লক্ষণ যথা বহুবচনের বিভক্তি বোর, হঁত, বিলাক প্রভৃতি দেখা যায় না। কর্মে ক, অধিকরণে ত
প্রভৃতি প্রাচীন বাংলা
ও আসামীর সাধারণ লক্ষণ।
সুতরাং বৌদ্ধ গানের ভাষাকে আসামী বলা সঙ্গত
নয়।
(৭) “ইহা বাঙ্গালা”। বাঙ্গালার বিশিষ্ট লক্ষণ বহু বচনের রা বিভক্তি ইহাতে
নাই। কিন্তু রা বিভক্তির প্রাচীন রূপ লোঅ ইহাতে দেখা যায়। বাস্তবিক কাহ্ণ, সরহ,
ভুসুকু প্রভৃতির ভাষা প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী
ভাষা। ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এই ভাষাকে পশ্চিম বঙ্গের ভাষা বলিয়া মনে
করেন। কিন্তু দুলি (সিলেট ও আসামী দুরা কচ্ছপ অর্থে), রুখ (বৃক্ষ অর্থে), গাতো (Ms. গাতী,
গর্ত অর্থে), উঞ্চল পাঞ্চল, আলা জালা, জোইনি
(পূর্ব বঙ্গ জুনি, জোনাকী অর্থে) প্রভৃতি শব্দগুলি পশ্চিম বঙ্গে
প্রচলিত ছিল কি না, তাহার প্রমাণ নাই। কিন্তু এগুলি পূর্ব বঙ্গে
কিছু পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিতরূপে এখনও কথ্য ভাষায় প্রচলিত আছে। কুক্কুরী পাদের ধরণ না জাই পূর্ব বঙ্গে ধরণ যায় না, কিন্তু
পশ্চিম বঙ্গে ধরা যায় না।
তবে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে “ধরণ
না জাএ” ব্যবহত হইয়াছে। হয়ত যে শব্দগুলি বর্তমানে
পূর্ব বঙ্গে এবং আসামীতে প্রচলিত আছে,
প্রাচীন কালে তাহা পশ্চিম বঙ্গেও প্রচলিত
ছিল। দৃষ্টান্ত স্থলে পিন্ধে (পরিধান করে) এখন পূর্ব বঙ্গে প্রচলিত থাকিলেও
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ইহার প্রয়োগ দেখিয়া মনে হয় পশ্চিম বঙ্গেও ইহার প্রয়োগ ছিল। এখন ২৪ পরগণার কোনও কোনও স্থানে ইহার ব্যবহার আছে। আমরা বৌদ্ধ গানের বাঙ্গালা
ভাষাকে পশ্চিম বঙ্গের বলিয়া নির্দশ না করিয়া কেবল প্রাচীন বাঙ্গালা কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে
প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করি।