মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী : তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতিচিন্তা
Abstract
ব্যাপক দেশবাসীর কাছে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিচয় শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী দেশীয় ঘাতক গোষ্ঠীর নিশানা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে যাঁরা প্রাণ হারান, দেশের সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের নিহত তিনজন শিক্ষকের অন্যতম তিনি। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পত্রিকায় আরো কয়েকজন শহিদ লেখক-শিক্ষক-সাংবাদিক-চিকিৎসক ও অন্য বিশিষ্ট পেশাজীবীর সঙ্গে তাঁরও নাম ও ছবি ছাপা হয়। এর অতিরিক্ত আমাদের উচ্চশিক্ষিত পরিমণ্ডলেও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কৃতি ও কীর্তি সম্পর্কে বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হয় না। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে : (এক) বিভিন্ন সময় স্বনামে ও বেনামে কিছু গল্প-কবিতা-গান-নাটিকা ইত্যাদি লিখলেও, সৃষ্টিশীল লেখক বলতে যা বোঝায় তিনি তা ছিলেন না; (দুই) ছাত্রজীবনে প্রখর মেধাশক্তির পরিচয় দিলেও, তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশেষ ধাঁচের (কবীর চৌধুরী যার উল্লেখ করেছেন ‘আত্মমগ্ন ব্যক্তিত্ব' বলে) কারণেই হয়তো শিক্ষক হিসেবে তিনি আকর্ষক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেননি; (তিন) মানুষ হিসেবে নম্রভাষী শুধু নয়, ছিলেন কিছুটা গোটানো স্বভাবেরও। যদিও আমাদের জাতীয় ইতিহাসের নানা পর্বে, বলা যায়, সকল সমস্যা ও সংকটে, মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ, ক্লান্তিহীন। সেদিক থেকে আমাদের সমাজে তিনি আমৃত্যু একজন সদাজাগ্রত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শুধু যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তিনি কলমযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন, তাই নয়। কিংবা প্রবন্ধ লেখাতেই তাঁর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল না। সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করে, পত্রপত্রিকায় এমনকি চিঠিপত্র কলামে লিখেও তিনি তাঁর মত-মন্তব্য, প্রস্তাব-পরামর্শ এবং কখনো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কোন বিষয়ে তিনি লেখেননি? শিক্ষাসমস্যা ও তার সংস্কার, রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক, গণতন্ত্রের সংকট, ভারত-পাকিস্তান সম্প্রীতি, নগর পরিকল্পনা (শহরের কেন্দ্রস্থলে স্টেডিয়াম ও মসজিদ নির্মাণের বিরোধিতা করে ও শিশুদের জন্য পার্ক বা খেলাধুলার মাঠের দাবি জানিয়েও তিনি লিখেছেন), রেল ও সড়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। আর এ সব বিষয়েই তাঁর যুক্তিবাদী ও কল্যাণকামী মনের সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।