মুনীর চৌধুরীর জীবনকথা
Abstract
মুনীর চৌধুরীর জীবনকথা
রফিকুল ইসলাম
উনিশে মার্চ রবিবার বিকাল চারটা
মুনীর চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি আজ থেকে পঁচিশ বছর আগ। তখন তিনি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ. পড়া শেষ করেছেন। ১৯৪৭ সালের কথা, সে সময়ে আমি স্কুলের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই আমাদের বাড়ী থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র আমার অবাধ গতিবিধি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন এত ছাত্র ছিলনা, ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল আরও কম, মুসলমান ছাত্রী যে কয়জন ছিলেন তাদের হাতে গোনা যেত। মুনীর চৌধুরী তখনই একটি সুপরিচিত নাম, তবে ভাল ছাত্র হিসেবে নয়, অন্য কারণে। তিনি তখন রাজনীতি করতেন, শুধু সখের ছাত্র রাজনীতি নয়, পুরোপুরী বিপজ্জনক বামপন্থী রাজনীতি ৷ তবে কেবলমাত্র সে কারণেই তিনি সেকালে ঢাকায় খ্যাতিমান ছিলেন না৷ তার জনপ্রিয়তার একটি কারণ হয়তো ছিল এই যে চমকপ্রদ কিছু ছোটগল্প ও নাটিকা তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু সে সময়ে তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ ছিল তার অদ্ভুত বক্তৃতা করবার ক্ষমতা। ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয় সে সময় পুরোপুরি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শহরের বিদ্যায়তন কয়েকটিই কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত ছিল। আবাসিক বিশ্ব-বিদ্যালয় ছিল বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক জীবন ছিল খুবই কমতৎপর। নাটক, তর্ক-বিতর্ক, সাহিত্য প্রতিযোগিতা আর ক্রীড়৷ প্রতিযোগিতাগুলো ছিল খুবই জমজমাট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের বার্ষিক ক্রীড়৷ ও সাহিত্য প্রতিযোগিতা আর ভোজ অনুষ্ঠানগুলো খুবই আকর্ষণীয় হত। সাহিত্য প্রতিযোগিতায় আমরা দেখেছি মুনীর চৌধুরীর আধিপত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতিতে তখন শুনেছি মুনীর চৌধুরীর অনবদ্য বক্তৃতা। তিনি সেকালে ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন, তখনকার রেওয়াজ ছিল তাই। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর সরস কথকতার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যেত, বিশ্ব-বিদ্যালয় খেলার মাঠে ক্রীড়৷ প্রতিযোগিতাসমূহে। ক্রীড়ার অনুষ্ঠান ঘোষকরূপে মুনীর চৌধুরী অনুষ্ঠান ঘোষণাকে এমন সরস ও কৌতূহল উদ্দীপক করে তুলতেন যে খেলার মাঠে সেটাই থাকত সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। বলাবাহুল্য যে শীতের অপরাহ্নগুলোর খেলার মাঠ মুনীর চৌধুরীর অনবদ্য বাংলা কথকতায় জমে উঠত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অনার্সের ছাত্র হবার আগে মুনীর চৌধুরী আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন ১৯৪১-৪৩ সালে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি আলীগড়ে আই. এস. সিতে ভর্তি হন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আরও যে সব বাঙ্গালী ছাত্র ছিলেন তাদের মধ্যে মরহুম এ. টি. এম. মুস্তাফা এবং জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর কথা আমরা মুনীর চৌধুরীর মুখেই শুনেছি। ঐ তিনজনই ভাল বক্তা হিসেবে পরিচিত, জানিন। এ দক্ষতা তারা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছিলেন কিনা। মুনীর চৌধুরী সাহেব বলতেন আলীগড়ে যখন তিনি পড়তেন তখন তার পরিচ্ছদ ছিল শেরওয়ানি ও আলীগড়ী পাজামা। আমি কিন্তু মুনীর চৌধুরীকে গত পঁচিশ বছর ধরে সাধারণতঃ পাজামা পাঞ্জাবী-তেই দেখেছি। পরিচ্ছদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম এ জন্যে যে এ বিষয়ে বহু বছর আগের একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। আজ থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ বছর আগের কথা, ফজলুল হক হলে কি একটা সভা ছিল, সভার শেষে সন্ধ্যা বেল৷ হলের সামনে মুনীর চৌধুরী একট। সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন সঙ্গে তার কিছু ভক্ত। কথা হচ্ছিল পোশাক সম্বন্ধে। মুনীর চৌধুরী তখন তরুণ যুবক, সুদর্শন, ছিপছিপে, সাইকেল ধরে দাঁড়ানো, পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী, চুলগুলো উদ্ভ্রান্ত, তিনি পাশ্চাত্য স্যুট কোটকে পরিহাস করে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন স্যুট কোট পরলেই আমার মনে হয় খাঁচার মধ্যে, কারাগারে প্রবেশ করেছি। তার কিছু দিনের মধ্যেই তাকে কারাগারে যেতে হয়, সেই তার প্রথম কারাবাস এবং বামপন্থী রাজনীতির জন্যে ১৯৪৮ সালে। মুনীর চৌধুরী উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর পুত্র, তাঁর পিতা মরহুম হালিম চৌধুরী সে কালেই জেলা প্রশাসক ছিলেন, আলীগড়ের ছাত্র মুনীর চৌধুরী ছুটিতে বাড়ী এলেও আলীগড়ী চালচলন বজায় থাকত। শেরওয়ানি পাজামা শোভিত, হাতে দামী বিলাতি সিগারেটের টিন, বাবার সরকারী জিপ চালিয়ে বেড়াতেন। চলা বলা হাবভাবের মধ্যে আলীগড়ের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ একটা কৃত্রিম নবাবী চালচলন। অথচ সে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে বামপন্থী রাজনীতি আর প্রগতি সাহিত্য সংসদে ঝুঁকে পড়লেন। পোশাক পরিচ্ছদে বাঙালী হয়ে গেলেন, সাইকেল হল নিত্য সাথী। তখন পার্টি অফিস ছিল কোর্ট হাউস ষ্ট্রীটে, প্রতিদিন হাতিরপুল 'দারুল আফিয়৷’ থেকে বা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে কোর্ট হাউস ষ্ট্রীটে সাইকেলেই যাতায়াত চলত। মাঝে মাঝে তাঁকে দেখা যেত পথ সভায় চোঙ্গা ফুঁকতে। এর মধ্যে একটা নাটকীয় বৈশিষ্ট্য আছে বৈকি। তবে রাত্রিগুলো তিনি অতিবাহিত করতেন অধ্যয়নে, পাঠ্য পুস্তকে নয়, বিদেশী সাহিত্য পাঠে কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি মুনীর চৌধুরীর ধাতে সহ্য হয়নি অর্থাৎ ঐ রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে তিনি বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। ঐ রাজনীতি তিনি যতদিন করেছেন ততদিন ভীষণভাবে করেছেন। চট্টগ্রামে এবং সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলে সে কারণে মুনীর চৌধুরী গোঁড়া দক্ষিণ পন্থীদের হাতে প্রহৃত হন। মুসলিম হলে সেদিন তার সঙ্গে আরও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন এ. কে. এম. আহ্সান যিনি পরে উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা হয়েছিলেন। সেদিন বিশ্ববদ্যালয়ে বাম-পন্থী রাজনীতিতে মুনীর চৌধুরীর সতীর্থ ছিলেন আখলাকুর রহমান, সরদার ফজলুল করীম এবং মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন নাদিরা চৌধুরী। লক্ষণীয় যে আখলাকুর রহমান বা সরদার ফজলুল করীমও রাজনীতির ঐ পথ থেকে ফিরে এসেছিলেন। কেউ আগে কেউ পরে অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ কারণে আমরা মুনীর চৌধুরীকে পরবর্তী কালে যতট। অভিযুক্ত করেছি অন্যদের ততটা করিনি। বস্তুতঃ পক্ষে রাজনীতি মুনীর চৌধুরীর জন্যে ছিলনা, সে যে রাজনীতিই হোক না কেন৷ সে কারণেই সে দিন রাজনীতিক অপেক্ষ।